হজরত জাফর সাদেক এর জীবনী। hajrat jafor sadik

 

হযরত জা'ফর সাদেক রহমাতুল্লাহ আলাইহি

   হযরত জা'ফর সাদেক রহমাতুল্লাহ আলাইহি তাঁর উপনাম আবু মুহাম্মদ । তিনি হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাতো ভাই ও জামাতা হযরত আলী কাররামাল্লাহুর বংশধর ছিলেন। তাঁর জীবনী সর্বপ্রথমে এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হল । তিনি কোরআন, হাদীস ও এলমে মা'রেফতে একজন বিশেষ জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মাওলার একজন খাঁটি আশেক ছিলেন। 

কতল করার জন্য ডেকে সম্মান দান-  তৎকালীন বাদশাহ্ খলীফা মসূর হযরত সাদেকের বিরাট ব্যক্তিত্ব ও তাঁর প্রতি লোকজনের অগাধ ভক্তি ও ভালবাসা দেখে অত্যন্ত চিন্তিত ও ভীত হয়ে পড়েন। তাই তাঁর উযীরকে ডেকে বললেন, “যাও, সাদেককে ধরে আন, আমি তাঁকে কতল করব।” উযীর বিনীতভাবে আরয করলেন, “বেচারা নীরবতার মধ্যে থেকে ইবাদতে মশগুল, সংসার হতে স্বীয় হস্তকে গুটিয়ে নিয়েছেন, তাঁর পতি ক্রোধ প্রকাশ করলে ও তাঁকে কতল করলে আপনার কি উপকার হবে? খলীফা বললেন, “যাই হোক না কেন, তাঁকে আমার দরবারে আনতেই হবে।” উযীর পুনপুনঃ নিষেধ করেও যখন খলীফার মনের গতি ফিরাতে পারলেন না, তখন হযরত সাদেককে ডাকতে গেলেন। খলীফা চাকর-নওকরদেরকে ডেকে বললেন, মুহূর্তে সাদেককে দরবারে হাজির করা হবে, আমি তখনই মাথার তাজ খুলে ফেলব। এটা দেখলে তোমরা সাদেকের মস্তক দুই টুকরা করে ফেলবে।” হযরত সাদেক রহমাতুল্লাহ আলাইহি যথাসময়ে খলীফা মসূরের দরবারে পৌছলেন। মসূর উঠে বিনীতভাবে হাঁটু নত করে হযরত সাদেককে তাঁর তখতে বসালেন। দরবারে উপস্থিত লোকেরা এটা দেখে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হল। মসূর হযরত সাদেককে বললেন, “আপনি আমার কাছে কি চান?” হযরত সাদেক উত্তরে বললেন, “আমাকে আবার ডেকে আমার ইবাদতে বিঘ্ন ঘটাবেন না, এটাই আমি চাই।” খলীফা মসূর স্বসম্মানে তখনই তাঁকে বিদায় দিলেন। তাঁকে বিদায় দানের পরক্ষণেই খলীফা সরের কম্পন উপস্থিত হল এবং তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় তাঁর তিন ওয়াক্ত নামায কাযা হয় । 

খলীফার জ্ঞান ফিরে আসলে উযীর আরয করলেন, “আপনার এ অবস্থা হল কেন?” খলীফা বললেন, “যখন হযরত সাদেক আমার দরজায় প্রবেশ করেন, তখন তাঁর সাথে আমি এক অজগরকে দেখলাম। অজগরটি যেন ফণা বিস্তার করে আমাকে বলছিল, “হে মনসুর! যদি তুমি সাদেককে কষ্ট দাও, আমি তোমাকে দংশন করব।” এর ভয়ে আমি হযরত সাদেকের খেদমতে ওযর-আপত্তি জানিয়ে মা'ফ চাইলাম এবং বেহুঁশ হয়ে পড়লাম।" 

নেক আমল দ্বারা মুক্তির আশা করা যায় বংশ দ্বারা নয়- হযরত দাউদ তায়ী একদিন হযরত সাদেকের কাছে এসে বললেন যে, আপনি যেহেতু হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধর আমাকে কিছু নসীহত করুন। হযরত সাদেক বললেন, “সোলায়মান! তুমি বর্তমান সময়ের একজন যাহেদ। আমার নসীহতে তোমার কি প্রয়োজন? সোলায়মান বললেন, “হে পয়গম্বরের বংশধর! আপনি বর্তমানে দুনিয়ার সকল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে আমাদেরকে নসীহত করা আপনার উপর ওয়াজিব।” হযরত সাদেক বললেন, “কিয়ামতের দিন যদি আমার নানাজি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কেন আমার তাবেদারী করলে না? উচ্চ বংশ দ্বারা নসীহত হয় না, আমল (কর্ম) দ্বারাই সত্যকে বুঝতে পারা যায়”, তখন আমি কি উত্তর দেব?” এই ভয়ে আমি কম্পিত। এতদশ্রবণে হযরত সোলায়মান বহুত নসীহত গ্রহণ করলেন এবং “কেঁদে বললেন, 'হে আল্লাহ্, তোমারই নবীর রক্তের মিলনে যাঁর শীর গঠিত, যাঁর চরিত্র রাসুলল্লাহর চরিত্রের আদর্শে গঠিত, যাঁর নানাজী তোমার রাসূল, মা আদর্শ মহিলা, তিনিই যখন নিজ কার্য সম্বন্ধে এতটা ভীত ও সন্ত্রস্ত, তখন দাউদ এমন আর কোন্ মানুষ যে আপন কার্যে খুশী হবে।” 

   একদিন হযরত সাদেক বন্ধুদেরকে বললেন, “আস্, আমরা সকলে এই প্রতিজ্ঞা করি-আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন মুক্তি পাবে, সে অপরের গুনাহ্ মাগফেরাতের জন্য আল্লাহ্ পাকের দরবারে সুপারিশ করবে।” তাঁরা বললেন, “সাদেক! আমাদের এই প্রকার প্রতিজ্ঞার কি প্রয়োজন? আপনার নানাজী স্বয়ং সুপারিশকারী।” হযরত সাদেক উত্তরে বললেন, “আমি নিজের কাজের জন্য হাশরের দিন নানাজীর প্রতি দৃষ্টিপাত করতে লজ্জাবোধ করি। এজন্য আপনাদের কাছে আরয করেছিলাম।” 

পোশাকের বিধান- একদিন হযরত সাদেককে মুল্যবান পোশাক পরানো হয়েছিল। এটা দেখে এক ব্যক্তি বলল, “আপনি নবীর বংশধর। এরূপ সুকোমল মুল্যবান পোশাক আপনার পক্ষে শোভা পায় না।”  হযরত সাদেক তাঁর আস্তিনের ভিতরের দিকে নযর করতে তাকে ইঙ্গিত করলেন । আস্তিনের নীচে মোটা কাপড় খসখসে বোধ হল । তিনি বললেন, “আমার একটি জামা আল্লাহ্ তাআলার দরবারে নামায পড়ার জন্য অন্যটি মানবসমাজে চলাফেরার জন্য।” 

নসীহতপূর্ণ ঘটনা- একদিন এক ব্যক্তি হাজার টাকার একটি থলে হারিয়ে ভুলক্রমে হযরত সাদেককে আক্রমণ করে । ঐ ব্যক্তি হযরত সাদেককে চিনত না। হযরত সাদেক বললেন, ”থলেয় কত টাকা ছিল?” সে বলল, “হাজার টাকা।” তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ীতে গেলেন এবং হাজার টাকা দিয়ে দিলেন। পরে লোকটি তার টাকা পেয়ে হযরত সাদেকের টাকাগুলো ফেরত নিয়ে আসল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করলেন না; বরং বললেন, “আমি যা দান করেছি, তা আবার গ্রহণ করি না।” লোকটি হযরত জা'ফর সাদেককে চিনতে পেরে অতিশয় লজ্জিত হল । 

   একদিন হযরত সাদেক কোন এক রাস্তার উপর দিয়ে “আল্লাহ্ আল্লাহ্” যিকির করতে করতে যাচ্ছিলেন। সেই সময়ে একজন দুঃখী লোক 'আল্লাহ' 'আল্লাহ' বলতে বলতে তাঁর সাথী হয়ে গেল। এমন সময় হযরত সাদেক বললেন, “আল্লাহ্! পরনে কাপড় নেই, গায়ে চাদরও নেই।” হঠাৎ গায়েব হতে কয়েকটি মূল্যবান কাপড় পেলেন ও তা পরিধান করলেন। এটা দেখে সঙ্গের দুঃখী ব্যক্তি বলল, “আল্লাহ্ যিকিরে আমিও আপনার সঙ্গে শরীক ছিলাম, কাজেই আপনার পুরাতন কাপড় আমাকে দান করুন।” হযরত তৎক্ষণাৎ তাকে পুরাতন জামাগুলো সদ্‌কা দিলেন । 

নসীহত করার তরীকা এক ব্যক্তি হযরত সাদেকের কাছে এসে বলল, “আমি আল্লাহকে দেখতে চাই, তাঁকে আমার কাছে হাযির করুন।” হযরত সাদেক বললেন, “তুমি কি শুননি যে, আল্লাহ্ মূসাকে বলেছিলেন, 'তুমি কখনই আমাকে দেখতে পাবে না' সে বলল, “হাঁ, তবে এটা মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বীন ইসলাম । হযরত মূসার যুগ অতীত হয়ে গেছে। তাছাড়া মিল্লাতে মোহাম্মাদীর গণ্ডির ভিতরে থেকে কোন এক ওলী বলতেন, আমার অন্তর আমার রবকে দেখেছে । এটা শুনে অপর এক ওলী চীৎকার করে বলে উঠলেন, তাঁকে না দেখে আমি রবের ইবাদত বন্দেগী করি না। এটা শুনে হযরত সাদেক মুরীদদেরকে বললেন, “একে বাঁধ ও নদীতে ফেলে দাও।” তাঁকে নদীতে ফেলে দেওয়া হল । ‘কিন্তু পানি তাঁকে উপরে উঠিয়ে দিয়েছিল এবং হযরতের কাছে সাহায্য চাইল । হযরত সাদেক এটা দেখে পানিকে বললেন একে ভালোমত হাবুডুবু খাওয়াও। কিছুক্ষণ হাবুডুবু খাওয়ার পর যখন মরণাপন্ন ও নিরাশ হয়ে পড়ল, তখন সে “আল্লাহ্ আল্লাহ্” বলে চীৎকার করে উঠল। হযরত সাদেক বললেন, “তাকে উঠিয়ে আনো।” কিছুক্ষণ পর লোকটি শান্ত হলে হযরত সাদেক জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন, আল্লাহকে দেখেছ?” সে উত্তর করল, “যতক্ষণ অপরের সাহায্য চাচ্ছিলাম, ততক্ষণ পর্দার আড়ালে ছিলাম । কিন্তু যখন খাঁটি মনে আল্লাহ্কাছে সাহায্য চাইলাম, তখন অন্তরের মুখ খুলে গেল ও প্রথমবারের মত কষ্ট কমে গেল। যেমন, আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন, কে আছে ফরীয়াদকারীর ফীয়াদের উত্তর দেবে?” 

হযরত সাদেক বললেন, “যতক্ষণ তুমি আমাকে ডাকছিলে ও আমার উপর ভরসা করছিলে, ততক্ষণ তুমি অসত্যবাদী ছিলে। এখন যে জ্ঞান লাভ করলে, তা অতি-যত্নের সাথে মনে রেখ।"

নসীহত

গুনাহ্ কাজ করার সময়ে ভীত হওয়া এবং শেষে মাগফেরাত কামনা করা একটি বিশেষ গুণ । এটা সুফীকে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করায় এবং যে ইবাদতের শুরুতে ভয় এবং শেষে ওযর ও অনুতাপ না থাকে সেই ইবাদত সুফীকে আল্লাহ্ রহমত হতে রাখে । 

* অহংকারী সুফীকে প্রকৃত সুফী বলা যায় না। কারণ, সে গোনাহগার; আর যিনি মা'রেফাত কামনা করেন তিনিই সুফী-শ্রেণীভুক্ত। 

* পাঁচ ব্যক্তির সাথে সংস্রব রেখ না । 

(ক) মিথ্যুক তাকে সঙ্গে রাখলে ঠকবে। সে তোমার হিতকামী হতে পারে, কিন্তু নিজ মুর্খতার দরুন তোমার অমঙ্গল চাইবে। 

(খ) কৃপণ-সে সর্বদা নিজের লাভের জন্য তোমার ক্ষতি করবে। 

(গ) নির্দয়-অভাবের সময় সে তোমাকে ধ্বংস করবে। 

(ঘ) কাপুরুষ-তোমার প্রয়োজনের সময় সে তোমাকে ত্যাগ করবে। 

(ঙ) ফাসেক-তার লোভ-লালসা অত্যন্ত বেশী। নিজ স্বার্থের খাতিরে সে তোমাকে প্রাণে হত্যা করতেও পারে। 

এই দুনিয়াতেই বেহেশত ও দোযখের নমুনা বুঝার শক্তি আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে দিয়েছেন । শান্তি হল বেহেশ্ত ও দুঃখ-কষ্ট হল দোযখ। সঙ্গলাভ হল বড় জিনিস । কিন্তু অনেক সময় কাফেরের সঙ্গেও ওলী থাকে এবং পয়গম্বরের সঙ্গেও কাফের ছিল। হযরত আসীয়া ছিলেন ফেরআউনের বিবি। অপরপক্ষে হযরত নূহ এবং হযরত লূত (আঃ)-এর বিবিরা কাফের ছিল। এজন্য নেক সঙ্গলাভের মধ্যে নেক নিয়ত থাকতে হবে ।

0 Post a Comment:

Post a Comment